ব্যাংক লোন পাওয়ার জন্য কি করতে হবে - What to do to get a bank loan

প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে থাকেন অনেকেই। ব্যাংক এর প্রধান কার্যক্রমসমুহের মধ্যে লোন অন্যতম। ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় অনেকের কাছেই কাঙ্ক্ষিত একটি ব্যাপার। ব্যাংক লোন এর মাধ্যমে লোন গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ই লাভবান হয়। ব্যাংক লোন নেওয়ার আগে লোন সম্পর্কে জরুরী ব্যাপারগুলো জেনে রাখা উচিত।

তবে আমাদের দেশের অনেক মানুষই ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় বা নিয়ম জানেন না বলে লোন নিতে পারেন না। চলুন জেনে নেয়া যাক ব্যাংক লোন কি, ব্যাংক লোন এর প্রকারভেদ ও ব্যাংক লোন কিভাবে পাবেন।
ব্যাংক লোন কী?

লোন মানে ধার নেওয়া বা ঋণ নেওয়া, এটা আমাদের সকলের জানা। প্রয়োজনে আমরা পরিবার, বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন থেকে টাকা বা অন্যান্য জিনিস ধার নিয়ে থাকি। এমনকি মোবাইলের ব্যালেন্স ও লোন নেয়া সম্ভব। এছাড়া মোবাইলে আপনি এমবি বা ইন্টারনেট ডাটাও লোন নিতে পারেন। পরে আবার একাউন্ট ব্যালেন্স থেকে এই লোন ফেরত দিতে হয়। ব্যাংকের ক্ষেত্রে লোনের ব্যাপারটা অনেকটা একই ধরনের।
একটি ব্যাংক যখন গ্রাহককে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থ ধার দেয়, তখন ওই অর্থ ব্যাংক লোন হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে শর্ত হচ্ছে উক্ত লোন পরিশোধের সাথে সাথে মাসিক বা বাৎসরিক একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ গ্রাহক কর্তৃক ব্যাংককে প্রদান করতে হয়।
ব্যাংক লোন এর প্রকারভেদ

মেয়াদের ভিত্তিতে ব্যাংক লোনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ

    স্বল্পমেয়াদী লোনঃ স্বল্পমেয়াদী লোন সাধারণত ১ থেকে ২ বছরের জন্য হয়ে থাকে। ব্যবসার প্রয়োজনে মূলত স্বল্পমেয়াদী লোন নেওয়া হয়। এসব লোনের ক্ষেত্রে অধিক সুদ প্রযোজ্য হয়। লোন এর সময় অতি সংক্ষিপ্ত হলে স্বাপ্তাহিক পরিশোধের সুবিধাও থাকতে পারে।
    মধ্য-মেয়াদী লোনঃ মধ্যমেয়াদী লোন মূলত ২ থেকে ৫ বছরের জন্য হয়ে থাকে। এটিকে স্বলমেয়াদী ও মধ্যমেয়াদী লোনের মাঝামাঝি লোন বলা চলে।
    দীর্ঘমেয়াদী লোনঃ দীর্ঘমেয়াদী লোন ৫ বছরের বেশি মেয়াদের হয়। বেশিরভাগ দীর্ঘমেয়াদি লোন সিকিউরড হয়ে থাকে।

ব্যাংক লোন কত ধরনের

উপরোক্ত প্রকারভেদ ছাড়াও ব্যাংক লোনকে আরো বিভিন্ন ধরনে ভাগ করা যায়। কারণ সাপেক্ষে ব্যাংক লোন ও বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে, যেমনঃ

    পার্সোনাল লোনঃ ব্যক্তিগত কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য লোন
    বিজনেস লোনঃ ব্যবসা করার বা ব্যবসায় কাজে লাগানোর জন্য লোন
    হোম লোনঃ বাড়ি কেনার বা তৈরীর জন্য লোন
    অটো লোনঃ গাড়ি কেনার জন্য লোন
    এসএমই লোনঃ ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসার জন্য লোন
    এডুকেশন/স্টুডেন্ট লোনঃ লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে লোন
    প্রবাসী লোনঃ দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য লোন
    কৃষি লোনঃ কৃষি সম্পর্কিত কাজের জন্য লোন
    কুইক লোনঃ জরুরি প্রয়োজনে প্রদত্ত লোন


যেসব কারণে ব্যাংক লোন দেয়

ব্যাংক থেকে লোন নিতে হলে লোন নেওয়ার কারণ দেখানো বাধ্যতামূলক। কিছু উল্লেখযোগ্য লোন দেওয়ার কারণসমুহ হলোঃ

    ব্যাক্তিগত কাজে
    বাড়ি নির্মাণে
    গাড়ি কিনতে
    চিকিৎসার জন্য
    পড়াশোনার জন্য
    ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য
    কৃষিকাজের জন্য
    প্রবাসে যাওয়ার জন্য
    দুর্যোগ বা বিপদে তাৎক্ষণিক সাহায্যে

যেসব ব্যাংক লোন দেয়

আমরা আগেই জেনেছি যে লোন প্রদান ব্যাংকের অন্যতম প্রধান একটি কাজ। বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকই উল্লেখিত প্রায় সকল ধরনের লোন প্রদান করে থাকে। তবে একেক ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট ও মাসিক ইন্সটলমেন্ট একেক ধরনের হয়ে থাকে। তাই লোন নেওয়ার আগে অবশ্যই যে ব্যাংক থেকে লোন নিচ্ছেন, সে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট ও মাসিক ইন্সটলমেন্ট এর ব্যাপারে জেনে নিবেন।
লোন পাওয়ার শর্তসমুহ

লোন দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক কিছু শর্ত প্রদান করবে, এটাই স্বাভাবিক। আপনি যদি ব্যাংক প্রদত্ত শর্তসমূহ পূরণ করতে পারেন, তবেই লোনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। লোন দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক  জানতে চাইবেঃ

    লোন কেনো নেওয়া হচ্ছে
    ক্রেডিট হিস্ট্রি
    ব্যাক্তিগত তথ্য
    চাকরি বা ব্যবসার অভিজ্ঞতা
    লোনের অর্থ ব্যবহারে গ্রাহকের পরিকল্পনা
    ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট
    ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট
    পূর্বের লোনের তথ্য (যদি থাকে)

ব্যাংক লোন পেতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

বেশিরভাগ ব্যাংক লোন এর ক্ষেত্রেই একই ধরনের কাগজপত্রের দরকার হয়। ব্যাংক লোন পেতে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসমুহ হলোঃ

    স্বাক্ষরসহ যথাযথভাবে পূরণ করা আবেদন ফরম
    সম্প্রতি তোলা ছবি
    জাতীয় পরিচয়পত্র/ড্রাইভিং লাইসেন্স/পাসপোর্ট এর ফটোকপি
    অফিস আইডি ফটোকপি
    স্যালারি সার্টিফিকেট
    যেকোনো ইউটিলিটি বিল এর কপি
    ট্রেড লাইসেন্স
    ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন অনুলিপি
    চেকবুক পেজ
    ব্যাংক স্টেটমেন্ট

লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে লোন যিনি নিচ্ছেন, তার পক্ষ থেকে একজন গ্যারান্টার যুক্ত করতে হয়। গ্যারান্টার এর ছবি, এনআইডি, অফিস আইডি, ইত্যাদি কাগজপত্র চাওয়া হয়ে থাকে। লোন গ্রহীতা যদি লোন পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবে ব্যাংকের কাছে গ্যারান্টারকে জবাবদিহি করতে হয়। এছাড়া উইটনেস বা স্বাক্ষী দরকার হবে।

উল্লেখ্য যে আপনি কোন লোন নিবেন, সেটার উপর ভিত্তি করে উল্লেখিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তারতম্য দেখা যেতে পারে। সাধারণত লোন নিতে কি কি কাগজপত্র লাগবে সেটা ব্যাংক থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়।
ব্যাংক লোন এর জন্য আবেদন

কাগজপত্র ও প্রযোজ্য শর্তের কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়ে গেলে এবার ব্যাংক লোন এর জন্য আবেদন করতে হবে। লোন এর আবেদনের ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্য, যেমনঃ লোন নেওয়ার কারণ, লোন এর পরিমাণ, ইত্যাদি প্রদান করে আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে। এই আবেদন ফরম ব্যাংক থেকে দেওয়া হবে।

ফরম পূরণ করে আবেদন করা হলে ব্যাংক থেকে আপনাকে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকতে পারে, যেখানে মূলত লোন নেওয়ার তথ্য সম্পর্কে বিষদভাবে জানতে চাওয়া হয়। এরপর ভেরিফিকেশন করা হবে ব্যাংক থেকে। ভেরিফিকেশন করার পর যত দ্রুত সম্ভব আপনার লোন এর টাকা ব্যাংক একাউন্টে পেয়ে যাবেন।
লোন নেওয়ার আগে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা উচিত

প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে লোন নিতে কোনো বাধা নেই। তবে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা একান্ত জরুরি। যেমনঃ

    লোন পরিশোধের পরিমাণ ক্রেডিট স্কোর এর উপর নির্ধারণ করা হয়। তাই লোন নেওয়ার সময় ক্রেডিট স্কোর জেনে নেওয়া শ্রেয়
    ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার আগে অবশ্যই যে ব্যাংক থেকে লোন নিচ্ছেন, সে ব্যাংকের সুদ এর হার, লোনের মেয়াদ, মাসিক ইন্সটলমেন্ট ইত্যাদি তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
    লোন এর প্রক্রিয়ায় প্রযোজ্য প্রসেসিং চার্জ সম্পর্কে জেনে নিন
    লোন পরিশোধে দেরি হলে সাধারণত ৫ থেকে ১০ শতাংশ লেট পেমেন্ট চার্জ প্রযোজ্য হয়। তাই লোন নেওয়ার আগে লেট পেমেন্ট চার্জ সম্পর্কে জানতে ভুল করবেন না
    লোন নেওয়ার আগে একটি নির্দিষ্ট অংক প্রি পেমেন্ট চার্জ হিসেবে গৃহীত হতে পারে, যা সম্পর্কে জানা একান্ত জরুরি

ব্যাংক লোন এর সুবিধা

ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা অনেক। যেমনঃ

    লোন এর মেয়াদের উপর ভিত্তি করে সময়সাপেক্ষে লোনের অর্থ পরিশোধ করা যায়
    সময়ের আগে কোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে আর্থিক সাহায্য করতে পারে ব্যাংক লোন
    ইন্টারেস্ট যেহেতু আগে থেকেই নির্দিষ্ট থাকে, তাই পরিশোধের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করে রাখা সম্ভব
    ক্রেডিট কার্ড বা মহাজন থেকে ধার করা টাকার ইন্টারেস্ট রেট এর চেয়ে ব্যাংক লোন এর ইন্টারেস্ট রেট অনেক কম হয়ে থাকে
    অনেক ক্ষেত্রে আপনি নামমাত্র সুদে লোন পেতে পারেন, যদি আপনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন অথবা তাদের সাথে আপনার প্রতিষ্ঠানের কোনো চুক্তি থাকে
    এছাড়া বর্তমানে ইসলামি ব্যাংক লোন (বিকল্প) রয়েছে যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সুদবিহীন পদ্ধতিতে আর্থিক সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়

ব্যাংক লোন এর অসুবিধা

সুবিধা যেহেতু আছে, অসুবিধা তো থাকবেই। ব্যাংক লোন এর কিছু উল্লেখযোগ্য অসুবিধা হলোঃ

    ব্যাংক লোন অনুমোদনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠোর বা স্ট্রিক্ট হয়ে থাকে, যার কারণে যেকেউ চাইলেই লোন নিতে পারেনা
    শিক্ষা, চিকিৎসা বা বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে লোন নেওয়ার টাকা থেকে যেহেতু লাভ আসেনা, তাই ইন্টারেস্ট এর টাকা অনেক বেশি মনে হতে পারে
    ঘর বা গাড়ি বন্ধক রেখে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে লোন পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঘর বা গাড়ি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে
    ব্যাংক লোন এর সাথে প্রযোজ্য বিভিন্ন অতিরিক্ত ফি লোনের বোঝা বড় করে তুলতে পারে

ব্যাংক লোন ও ক্রেডিট কার্ড

ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া ও ব্যাংক প্রদত্ত ক্রেডিট কার্ড – দুইটি একই ধরনের মনে হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ক্রেডিট কার্ড এর ইন্টারেস্ট এর চেয়ে ব্যাংক লোন ইন্টারেস্ট কম হয়ে থাকে। তাই নির্দিষ্ট কোনো খরচের জন্য বাড়তি অর্থ প্রয়োজন হলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার না করে লোন নেওয়াই উত্তম।

ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় – মূলকথা

অর্থের প্রয়োজনে লোন এর দরকার পড়ে কমবেশি সবারইঅনেকেরই। লোন নেওয়ার আগে অবশ্যই বিবেচ্য বিষয়গুলো ভেবে দেখুন। লোন নিয়ে পরিশোধের ক্ষেত্রে বাড়তি ইন্টারেস্ট প্রদান আপনার ক্ষেত্রে যথাযথ কিনা, তা বিবেচনা করে লোন নিন। সুদ এড়াতে চাইলে ইসলামি ব্যাংকিং এর বিকল্পগুলি যাচাই করে দেখুন।
ব্যাংক ঋণ বিষয়ে সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তরসমূহ
ব্যাংক লোন পেতে কী কী কাগজপত্র লাগে?

ব্যাংক থেকে লোন বা ঋণ পেতে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র, আর্থিক বিবরণী বিষয়ক ডকুমেন্ট, টিন সার্টিফিকেট প্রভৃতি দরকার হতে পারে। এটা অনেকটাই নির্ভর করে আপনি কী ধরনের লোন নিচ্ছেন এবং কোথা থেকে নিচ্ছেন।
সুদ বিহীন ব্যাংক লোন কীভাবে পেতে পারি?

সচরাচর ব্যাংক লোনের বিকল্প হতে পারে ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমের ইনভেস্টমেন্ট স্কিমসমূহ। বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিশ্রুত ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম রয়েছে যারা এই সুবিধা দেয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url